দরবশে জরপি শাহ্ ! নামরে শেষে আর্শ্চযবোধক চিহ্ন না যতটা  আপনাকে আর্শ্চয করবে বিংশ শতাব্দিতে এসেও তাঁর ইতহিাস বিজ্ঞান মনষ্ক আপনাকে নতুন করে ভাবাতে বাধ্য করব। অলি আউলিয়া ও পাগল ফকিরের দেশ এই বাংলাদেশ। ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অলি আউলিয়ারা ইসলাম প্রচার করতে এসেছিলেন এবং ধারণা করা হয় সবচেয়ে বেশি অলি আউলিয়া এসেছিলেন বাংলাদেশে বা উপমহাদেশের এই অংশে। বাংলাদেশের ময়মনসিংহ বিভাগের শেরপুর জেলার শ্রীবরদী থানার অন্তর্গত গড়জরিপায় দরবেশ জরিপ শাহ্ এর মাজার শরীফ অবস্থিত। দরবেশ জরিপ শাহ্ এর মাজার এবং মাজার এলাকা নিয়ে বহুপূর্ব হতেই বিভিন্ন অলৌকিক এবং ব্যাখ্যাতীত ঘটনার কথা শুনতে পাওয়া যায়।

দরবেশ জরিপ শাহ্ এর জন্ম এবং ঠিক কখন, কোথা থেকে, কিভাবে এ অঞ্চলে আসেন তার কোন স্পষ্ট সঠিক ধারণা না পাওয়া গেলেও ইতিহাস ও লোকমুখে তার সম্পর্কে অলৌকিক অনেক ঘটনার কথা জানা যায়।

প্রাচীন ধর্মীয় কাব্য সাহিত্যে কামরূপ নামক রাজ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়; বর্তমানের শেরপুর জেলার শ্রীবরদী থানার অর্ন্তগত গড়জরিপা ও এর আশেপাশের অঞ্চলও এই কামরূপ রাজ্যের অংশ ছিল এবং গড়জরিপার এ অংশে কোচ সামন্তদের বসবাস, দখল ও শাসন ছিল। তন্মেধ্যে দলিপ সামন্ত নামের এক রাজা এই অঞ্চল শাসন করতেন এবং তার নামে তার রাজ্যের রাজধানীর নাম ছিল গড়দলিপা।

পরবর্তীতে গড়দলিপার খোদিত লিপিতে সাইফুদ্দুনিয়া আব্দুল মোজাফফর ফিরোজ শাহ্ নামে এক সুলতানের উল্লেখ পাওয়া যায়। যতদূর মনে করা হয় তিনিই হাবশী বংশীয় সুলতান সাইফুদ্দিন ফিরোজ শাহ্ (১৪৮৬-১৪৯১)। তাঁর সময়েই মুসলমানেরা সেনাপতি মজলিস খাঁ হুমায়ূন মতান্তরে হুমায়ন শাহ্ আমীর হোসেনের নেতৃত্বে এই গড়দলিপায় অভিযান প্রেরণ করেন। হুমায়ূন কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে রাজা দলিপ সামন্ত পরাজিত ও নিহত হন।


দরবেশ জরিপ শাহ এর উদ্ভভঃ

    কথিত আছে যে, হুমায়ুন শাহ্ আমীর হোসেন সৈন্য সামন্ত, কুলি প্রভৃতিসহ গড়দলিপার জঙ্গল পরিষ্কার করে আবাদের উপযুক্ত করতে আসেন। তিনি গড়দলিপায় প্রবেশ করে দেখতে পান যে, জরিপা নামক এক দরবেশ যার দেহের অর্ধেক অংশ মাটির নিচে এবং অর্ধেক অংশ মাটির উপরে (পুতানো) অবস্থায় অবস্থান করছেন। তিনি (হুমায়ুন শাহ্ আমীর হোসেন) জরিপা দরবেশের নিকট উপস্থিত হলে এবং দরবেশকে উক্ত স্থান ত্যাগ করতে বললে দরবেশ বলেন আমি কিছুতেই এই স্থান ত্যাগ করব না; তবে এই শর্তে আমি এই স্থান ত্যাগ করতে পারি যদি এই স্থানে একটি গড় নির্মাণ করা হয় এবং আমার নামানুসারে এই গড়ের নাম দেওয়া হয় গড়জড়িপা। ধারণা করা হয় হুমায়ুন শাহ্ আমীর হোসেন তাই করেছিলেন এবং তখনই গড়দলিপা নামটি পরিবর্তীত হয়ে গড়জরিপা করা হয়। উল্লেখ্য যে, জরিপা দরবেশের মৃত্যুর পর তাঁকে এখানেই সমাহিত করা হয় এবং সেখানে তার মাজার স্থাপন করা হয়। আর তখন থেকেই তার মাজার ও মাজার এলাকা নিয়ে অনেক অলৌকিক ঘটনার কথা শুনতে পাওয়া যায়।


Dorbesh Jorip Shah Majar, History of Sherpur.

ছবি: দরবেশ জরিপ শাহ্  এর মাজার


মাজারের বিবরণঃ

    আনুমানিক ১৫০ হাত দৈর্ঘ্য ও ১০০ হাত প্রস্থ এক খন্ড জমিতে কবরস্থ করা হয়। জমিটির চারিদিকে দুইহাত পযর্ন্ত উচু দেওয়াল তৈরী করা হয়। এই জায়গাটির দক্ষিণ প্রান্তে একটি ছোট মসজিদ, উত্তর-পশ্চিম কোণায় কবরটি অবস্থিত। মাঝখানে পাকা করা ঈদগাহ্ মাঠ। কবরটি দৈর্ঘ্যে ১২ হাত প্রস্থে ৬ হাত। পূর্বে কবরটির চারদিকে দৈর্ঘ্যে বরাবর ১৫ হাত এবং প্রস্থ বরাবর প্রায় ১০ হাত এবং উচ্চতায় ৩ হাত উচু পাকা করা থাকলেও বর্তমানে এর সংস্কার ও উন্নয়নের কাজ অর্ধেকটা হওয়ার পর তা এখন পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। স্থানীয় লোকদের সাথে কথা বলে জানা যায় এই মাজারটির কোন সুসংঘঠিত স্থায়ী কমিটি না থাকায় এলাকাবাসীর উদ্যোগেই মাজারটির সংস্কার কাজ শুরু করলেও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তা থমকে আছে।

The Saint Jorip Shah, Dorbesh Jorip Shah, Sherpur, Gorjoripa
ছবি: দরবেশ জরিপ শাহ্  এর মাজার


মাজার ও ঈদগাহ্ মাঠের অলৌকিক ঘটনাঃ

    দরবেশ জরিপ শাহ্ এর মূল কবরের দৈর্ঘ্য ১২ হাত ও প্রস্থ ৬ হাত হলেও সবচেয়ে মজার এবং অলৌকিক ব্যাপারটি হল এর কোন সঠিক মাপ পাওয়া না। একবার মাপলে যে দৈর্ঘ্য পাওয়া যায় পরবর্তীতে মাপলে তার কিছুটা কম বা বেশি হয়। তাঁর কবরের পরিমাপের এই ভিন্নতার কারণ সম্পর্কে স্থানীয় লোকজন যেমন কিছু বলতে পারেন না অন্যদিকে ইতিহাস বা বইপত্রেও এর কোন কারণ বা ব্যাখ্যার উল্লেখ পাওয়া যায় নি। অপরদিকে স্থানিয় লোকদের নিকট থোক যানা যায় যে, কবর সংলগ্ন ঈদগাহ্ মাঠে প্রতি ঈদের নামাজের জন্য যত লোকের সমাগমই হোক না কেন জাইগাটি পূর্ণ হয় না বরং যে কোন অংশ খালিই থাকে এবং নামাজ শেষ হলে জাইগাটিতে সেই লোক আর ধরে না। স্থানীয় এক প্রবীণ ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানা যায়- পূর্বে যখন এ অঞ্চলে আর কোন ঈদগাহ্ মাঠ ছিল না এবং সকলেই এ ঈদগাহ্ মাঠে নামাজ পড়ত তখনও এর কোন এক অংশ বা কাতার খালি থাকত। বর্তমানে আরও কয়েকটি ঈদগাহ্ মাঠ থাকায় আর আগের মত লোকজন এখানে ঈদের নামাজ পড়তে আসে না কিন্তু নিকস্থ বা আশেপাশের যত লোকই এখনো এই মাঠে নামাজ পড়তে আসুক না কেন মাঠের কোন না কোন অংশ বা কাতার ফাকা থাকে।


মাজারে অবস্থিত পাথর খন্ডের ঘটনাঃ

        দরবেশ জরিপ শাহ্ এর নির্দেশ মত হুমায়ুন শাহ্ আমীর হোসেন ১১০০একর জমির উপর  গড় বা দূর্গ নির্মান করেছিলেন। দূর্গটি কাদামাটির তৈরী ৭ মিটার উচু প্রাচীর দ্বারা বৃত্তাকারে পরিবেষ্টিত ছিল। প্রাচীর গুলো আবার ৬টি পরিখা দ্বারা পৃথককৃত। অর্থাৎ একটি প্রাচীরের পর একটি পরিখা এই ভাবে সাজানো ছিল। স্থানীয় লোকেরা প্রাচীর গুলোকে জাঙ্গাল বলে থাকে।দুর্গ প্রাচীরের চারদিকে চারটি তোরন ছিল। পূর্ব পাশের তোরনটিকে কুমুদূয়ারী এবং পশ্চিম পাশেরটিকে পানি দূয়ারী, দক্ষিনের টিকে শ্যামসক দূয়ারী এবং উত্তরের টিকে খিরকি দূয়ারী বলা হত। যার কোনটিরই এখন চিহ্ন মাত্রও নেই। দূর্গ প্রাচীরের ভিতরে পানি দূয়ারীর কাছেই দুটি প্রস্থর ফলক পাওয়া যায়।

শেরপুরের অন্যতম জমিদার হরচন্দ্র চৌধুরী ১৮৭১ সালে প্রস্তুর ফলক দুটির একটিকে তদানিন্তন এশিয়াটিক সোসাইটিতে প্রেরণ করেন প্রস্তর ফলকটির উপর খোদাই করে আরবী লেখার বাংলা করার জন্য।

অপর পাথরটি ভেঙ্গে দুই টুকরা হয়ে যায়। বড় খন্ডটি যেখানে পড়ে আছে তার কাছেই একটি অনুচ্চ টিলা আছে এবং টিলাটির উপর বাঁশঝাড় আচ্ছন্ন। ধারণা করা হয় এই বাঁশঝাড়ের নিচেই হুমায়ূন শাহ্ আমীর হোসেনের কবর অবস্থিত।

লোকমুখে শোনা যায় যদি কোন ব্যক্তি জেদ ধরিয়া পাথরটিকে উপরে উঠাতে চায় তাহলে পারে না বরং সেই রাত্রেই সে দূরারোগ্য পীড়ায় আক্রান্ত হয়। এমনকি হাতি দ্বারা চেষ্টা করেও পাথরটিকে উঠানো সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে ঠিক কিভাবে পাথর খন্ড দুটি জরিপ শাহ্ এর মাজারে এলো তা জানা যায় নি।

মাজারের পশ্চিম পার্শে আরও একটি পাথার রয়েছে এবং পাথরটির জন্যও একটি আলাদা দান বাক্স রয়েছে। স্থানীয় লোকদের কাছে জানা যায় যে, লোকজন আসেন এবং পাথরটিতে পানি ঢালেন এবং সেই পাথর ধোয়া পানি পান করেন যেন তাদের মান্নত বা মনের আশা পূরণ হয়।


কালীদাস সাগর ও চাঁদ সওদাগর এর ডিঙ্গার বিবরণঃ

    দরবেশ জরিপ শাহ্ এর মাজার হতে দক্ষিণ-পশ্চিমে এক থেকে দের কিলোমিটার দূরত্বে প্রাচীরের ভিতরে  যে পরিখাটি ছিল তার দক্ষিণ-পশ্চিম ভাগের নাম কালিদহ সাগর স্থানীয় লোকেরা কালীদাস সাগর বলে থাকেন এবং এই কালিদাহ সাগরের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত চাঁদ সওদাগরের ডিঙ্গা।

ইহার দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০ হাতের মত। এই দ্বীপটিকে কোষা বা ডিঙ্গা বলা হয়। পূর্বে দ্বীপটি পূর্ব-পশ্চিমে লম্বিত এবং দুই মাথা উচু এবং মাঝখানে নিচু ছিল যা কিনা দেখতে একটি ডিঙ্গার মতই ছিল কিন্তু বর্তমানে এটি আর আগের মত দেখতে নেই। বিভিন্ন দিক থেকে এর দখল ও মাটি কাটাতে এই ডিঙ্গাটি এখন অনেকটাই ছোট গয়ে গেছে। কৌতুহলের বিষয় এই যে, বর্ষা বা বন্যায় সাগরের পানি যতই বৃদ্ধি পাক না কেন এই ডিঙ্গাটি কখনো ডুবে না। 

The boat of Chand Shoudagar, Kalidah Sagor, Kalidas Sagor.

ছবি: চাঁদ সওদাগরের ডিঙ্গা

জনশ্রুতি আছে যে, এটা চাঁদ সওদাগরের ডিঙ্গা। ধারণা করা হয় মনসা-মঙ্গলা  বা বেহুলা-লক্ষিন্দর কাব্যের চাঁদ সওদাগরের ডিঙ্গা এখানেই ডুবেছিল। বর্তমানে কালিদাহ সাগরের বিভিন্ন অংশে বানিজ্যিক ভাবে মাছ চাষ ও চাষের জন্য সংস্কার করা হলেও এই ডিঙ্গাটি সংরক্ষণ ও সংস্কারের অভাবে কালের গর্ভে বিলিন হয়ে যাচ্ছে। এই ডিঙ্গাটি বর্তমানে যে অংশে আছে তা থেকে আরেকটু দক্ষিণে এগুলে আমরা সানাইবান্দা ঘাট এর সন্ধান পাই বর্তমানে যার কোন অস্থিত্ব না থাকলেও স্থানীর লোকদের কাছ থেকে জানা যায় এই অংশটিতেই ছিল সানাইবান্ধা ঘাট যা বেশিদিন হয়নি স্থানীয় লোকেরা মাটি ভরাট করে বসবাস এর ভিটা তৈরী করেছে।


ছবি: কালিদহ সাগর

সানাইবান্ধা ঘাটের নিদর্শন স্বরূপ এখনো এখানকার মাটি খুরলে তৎকালীণ ঘাটে ব্যবহৃত ইটের দেখা পাওয়া যায় যা বর্তমানে ব্যবহৃত ইটের থেকে পুরোটাই আলাদা। মনসা-মঙ্গলা কাব্যের চাঁদ সওদাগর, কালীদহ সাগর ও ডিঙ্গা একই কিনা তার সঠিক তথ্য না পাওয়া গেলেও এখানকার পাওয়া তথ্য ও আলামতের ভিত্তিতে ধারণা করা যেতেই পারে যে, এটাই সেই কালিদহ সাগর যেখানে ডুবেছিল মনসা মঙ্গলা কাব্যের চাঁদসওদাগরের ডিঙ্গা।

সকল তথ্য সংগৃহিত ও লোকমুখে প্রচোলিত।


শেরপুর জেলার এই ইতিহাস ও ঐতিহ্য যা দিনের পর দিন অবহেলার কারণে কালের গহবরে বিলিন হয়ে যাচ্ছে। পৃষ্ঠপোষকতা, সংস্কার ও যথাযথ প্রশাসনের সুদৃ্ষ্টির যেমন অভাব অন্যদিকে স্থানীয় প্রভাবশালী ও অজ্ঞদের বেদখলের কারণে আমরা প্রায় হারাতে বসেছি আমাদের গোঢ়াকে। এর সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা ও সংস্কার আমাদের শেরপুর জেলার জন্য খুলে দিতে পারে এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার। এই গড়জরিপাও বিশ্বের বুকে রূপ নিতে পারে এক অনন্য ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান হিসাবে। তাই আমরা INFOTOTKA এর পক্ষ থেকে শেরপুর জেলার এই ইতিহাস ঐতিহ্যকে রক্ষার জন্য এই বিষয়ে যথাযথ প্রশাসন ও স্থানীয় সরকার প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করছি।